মারিয়ানা ট্রেঞ্জের আজর প্রানীরা- Strange creators in the mariana trench

এই পৃথিবীর কত না বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্য আছে বলেই তো পৃথিবী এত সুন্দর। মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িযে আছে কত দুর্গম দুর্লঙ্ঘনীয় স্হান। এই গ্রহের সবথেকে গভীর খাতের গভীরতা অনায়াসে গিলে নিতে পারে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টকে। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। মারিয়ানা ট্রেঞ্জ। বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম খাত। এই গভীর খাতের কথা তোমরা সকলেই হয়তো শুনেছো। কিন্তু তোমরা কি জানো, পরিচিত বিষয়গুলোও কত অজানা আজও আমাদের কাছে।

মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম এই খাতটি এমনই এক রহস্যময় স্থান, যেখানে প্রবেশের ক্ষমতা নেই সূর্যের আলোরও! কারন সূর্যের আলো সমুদ্রের গভীরে প্রায় হাজার মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। একসময় প্রশান্ত মহাসাগরের এই এলাকাগুলো ছিল স্পেনের উপনিবেশ। একসময় স্পেনের রাজা ছিলেন চতুর্থ ফিলিপ। তাঁর রানি ছিলেন মারিয়ানা। রানি মারিয়ানার সম্মানেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী হওয়ায় 2 হাজার 550 কিমি লম্বা ও 70 কিমি চওড়া এই খাতটিও 'মারিয়ানা খাত' নামে পরিচিত।


বহু বছর ধরেই খাতটিরগভীরতা মাপার প্রচেষ্ঠা চলেছে। তবুও আজ পর্যন্ত খাতটির সর্বশেষ সীমায় পৌঁছতে পারেনি মানুষ। 1948 সালে এইচ এম এস চ্যালেঞ্জার টু জাহাজের নাবিকরা। খাতটির প্রান্ত সীমায় গুয়াম দ্বীপের 340 কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে পৃথিবীপৃষ্ঠের গভীরতম বিন্দুটিকে আবিস্কার করেন। এই জাহাজের নাম অনুসারেই গভীরতম বিন্দুর নামকরন হয় এইচ এম এস চ্যালেঞ্জার টু। যার গভীরতা প্রায় 11 হাজার 33 মিটার। 1960 সালের জানুয়ারি মাসে মারিয়ানার গভীরে ডুব দেয় ফরাসি সাবমেরিন ব্যাথিস্কাপত্রয়েস্ত। কিন্তু 10 হাজার 900 মিটারের নীচে নামতে পারেননি অভিযাত্রীরা। তুলতে পারেননি কোন ছবিও। কারন এক আশ্চর্য রহস্যময় মেঘ ঘিরে রেখেছিল তাঁদের যাত্রাপথ। সমুদ্রের এত নীচে কোথা থেকে এল সেই মেঘ--এ রহস্য আজও রহস্যই থেকে গিয়েছে।

এখনও পর্যন্ত আবিস্কৃত মারিয়ানার সবচেয়ে গভীর যে অংশটি, সেটি শেষ অংশে জলের চাপ এতই তীব্র যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুর চাপের তুলনায় তা এক হাজার গুনেরও বেশি। সেকারণে এখানে জলের ঘনত্ব স্বাভাবিক অপেক্ষা 5 শতাংশ বেশি। ঘুটঘুটে অন্ধকার কনকনে ঠান্ডা আর আট টন অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে 15 হাছার 750 পাউন্ড জলের চাপেও এখানে প্রানের অভাব নেই। বিচিত্র ও অদ্ভুদদর্শন বহু সংখ্যক প্রানীর বাস এই স্হানে। মাইনাস 1 ডিগ্রি থেকে মাইনাস 4 ডিগ্রি সেলসিয়াসের হিমশীতল জলে তীব্র চাপ সহ্য করেও কীভাবে বেঁচে আছে এখানকার প্রানের অস্তিত্ব-- তা জানার জন্য বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীরা ব্যাস্ত। মারিয়ানার গভীর তলদেশে মৃত প্রাণীর কঙ্কাল, খোলস জমা হয় পরতে পরতে। ঠিক সমুদ্রের তলদেশের মতোই। সেজন্যই এখানকার জলের রং হলুদ। কখনও কখনও হাইড্রোজেন সালফাইড সহ বিভিন্ন ধরনের খনিজ সমৃদ্ধ গরম জল বের হয় চ্যালেঞ্জার ডিপের ছিদ্রপথ দিয়ে। যা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খেয়ে বেঁচে থাকে এমন কতগুলো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীব, যাদেরকে দেখতে হয় অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে। ওই জীবগুলো আবার মাছেদের খাদ্য। এভাবেই জলের গভীরে চলছে অদ্ভুদ বাস্তুতন্ত্র।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রথম অস্তরাই হল গাড় অন্ধকার। এখানকার বেশিরভাগ মাছই চোখে দেখতে পায় না। আজ তেমনই কিছু আজব প্রাণীদের কথা জানব।

সার্কাস্টিক ফ্রিঞ্জ হেড:




কলেবর বড়জোর 10 থেকে 12 ইঞ্চি। তাই নিয়েই দস্যিপনার শেষ নেই তার। সেজন্যই এদের অমন নাম সার্কস্টিক। এদের আক্রমণের ধরন যেমন অভিনব, তেমনই ভয়ঙ্কর। কারও উপস্হিতি টের পেলেই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বিশাল হাঁ করে আক্রমণ করে। আবার নিজেদের স্বজাতির মধ্যে গন্ডগোল বাধলেও এমনই ভাবে হাঁ করে পরস্পরের মুখে কামড়ে দেয়। আসলে ওদের সমাজে যার মুখ যত বড়, তাকে তত বেশি ক্ষমতাবান বলে মনে করে ওরা।

ফ্রিল্ড শার্ক:




প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যে সব নগণ্য সংখ্যক প্রাণী এখনও টিকে আছে, ফ্রিল্ড শার্ককে তাদেরই বংশধর বলে মনে করা হয়। সৃষ্ঠি থেকে আজ পর্যন্ত এদের পরিবর্তন হয়েছে খুবই সামান্য। তাই অনেকেই এদেরকে 'জীবন্ত জীবাস্ম' বলে থাকেন। উনিশ শতকে আবিস্কৃত এই মাছগুলো বিখ্যাত হয়ে আছে এদের দাঁতের জন্য। মুখভর্তি প্রায় 300 টি দাঁত চোয়ালের শেষ খাঁজ পর্যন্ত বিছানো। এরা লম্বায় মোটামুটি ছয় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। শিকারকে মুখের ভেতরেই পিষে মেরে গিলে ফেলে এরা।

ব্যারেল আই ফিশ:




1940 সালে এই মাছটি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এর মাথা ট্রান্সপারেন্ট অর্থাৎ স্বচ্ছ। মাথায় বসানো ব্যারেল আকৃতির দুটো চোখ চারদিকে আলো ছড়িয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত এই মাছটি সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি।

ডিপ সি ড্রাগন ফিশ:




সমুদ্রের ভয়ঙ্কর শিকারী প্রাণীদের অন্যতম এই প্রাণীটি। অঙ্কালহীন শরীরে ওদের আকারের তুলনায় ওদের দাঁতগুলো অতিমাত্রায় বড়। দেখতে হিংস্র হলেও ওরা লম্বায় মাত্র 15 মিটার। বায়োলুমিনেসেন্স পদ্ধতিতে নিজেদের শরীরে আলো তৈরি করতে পারে ওরা। চিবুকের কাছাকাছি ওদের একটি বিশেষ অঙ্গ ফোটোফার, যার সাহায্যেই ওরা আলো তৈরি করে শিকারকে বোকা বানায়।

ডাম্বো অক্টোপাস:




ডিজনির বিখ্যাত চরিত্র ডাম্বোকে তো তোমরা সবাই চেনো! সেই ডাম্বো হাতির বাস্তব রূপ যেন এই অক্টোপাস! এরাই সবচেয়ে গভীরে বাস করে। এরাও নিজেদের শরীরে আলো তৈরি করতে পারে। শিকারকে গিলে খেতে বড় ভালোবাসে এই অক্টোপাস।

আঙ্গলার ফিশ:




আঙ্গলার ফিশকে মানুষ জীবন্ত খুব কমই দেখেছে। কারন ওদের বাসা সমুদ্রের একেবারে তলদেশে। এদের পুরুষের স্ত্রীদের তুলনায় আকারে বেশ খানিকটা ছোটো হয়। পূরুষ আঙ্গলার সর্বসাকুল্যে মোটে 3 সেমি পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে স্ত্রী আঙ্গলার 18 সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়।

হ্যাচেট ফিস:




খানিকটা কুঠারের মতো দেখতে বলে ওদের নাম হ্যাচেট ফিস। এরা বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে সাধারনত এক থেকে ছয় ইঞ্চির মধ্যেই এদের দৈর্ঘ্য সীমাবদ্ধ থাকে। এদের একটি বিশেষ গুন হল এরা আশপাশের পরিবেশ অনুযায়ী ছদ্মবেশ ধারন করতে পারে। ডাম্বো অক্টোপাস ও ডিপ-সি ড্রাগনের মতো এরাও বায়োলুমিনেন্সের মাধ্যমে নিজেদের শরীরে আলো জ্বালতে পারে।

টেলিস্কোপ অক্টোপাস:




আটটি কর্ষিকাবিশিষ্ঠ টেলিস্কোপ অক্টোপাস অদৃশ্য হয়ে থাকে প্রায়শই। এর নামে টেলিস্কোপ শব্দটি যুক্ত হবার কারণ এর টিউবুলার চোখ। অদ্ভুত চোখটি ওদের লম্বা স্টকে বসানো থাকে। আর স্টকের প্রতিটি অঙ্গই নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করতে পারে। তাই আশপাশের সবদিকের উপর নজর রাখা এই টিউবুলার চোখটির জন্য খুব সহজ হয়ে যায়। এই চোখের দৌলতে অনেক শিকারি প্রাণীর হাত থেকে ওরা বাঁচতে পারে। অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতাও ওদের সে কাজটি আরও সহজতর করে দেয়।

2009 ও 2012 সালে আরও দু'বার মানুষ ডুব দিয়েছিল মারিয়ানার গভীরে। তবে সম্প্রতি আরও এক অভিযাত্রী ভিক্টরও পৌঁছেছিলেন 10 হাজার 927 মিটার পর্যন্ত। যা এখন রেকর্ড হিসাবে আছে। 2012 সালের 26 মার্চ ডিপ সি চ্যালেঞ্জার নামের এক সবুজাভ হলুদ সাব মার্সিবলে করে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে যাত্রা শুরু করেন টাইটানিকের বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরন। তাঁর মতে, চাঁদ জয় করার চেয়েও কঠিন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে যাওয়া।

আজও পর্যন্ত মানুষ মারিয়ানার যে গভীরতম অংশটিকে আবিস্কার করেছে সেটাই সর্বশেষ এটা ভালোভাবে বলা যায় না। এই গভীরতার শেষ স্তরে আমরা যেদিন পোঁচোতে পারব যেদিন, সেদিন এক অজানা জগতের দরজা আমাদের সামনে খুলে যাবে।

Post a Comment

0 Comments